দারুচিনি শুধু মসলা নয়, এর বেশি কিছু

দারুচিনি হলো এই গ্রহের সবচেয়ে বেশি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ ভেষজ। এর মিষ্টি স্বাদ ও সুন্দর সুবাসের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতিতেই আদৃত হয়ে আসছে। দারুচিনিতে রক্তের শর্করা রোধ করাসহ উন্নত অসাধারণ ঔষধি গুণাবলি রয়েছে, যা প্রদাহ কমাতে ও স্নায়বিক স্বাস্থ্য উন্নীত করতে সহায়তা করে। এ ছাড়া সুগন্ধি মসলা হিসেবে দারুচিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত। শুধু রান্নায় গন্ধ বৃদ্ধি নয়, শরীর ও ত্বক উভয়ের জন্যই দারুচিনি ব্যবহার করা যায়। এর অনেক উপকারিতা রয়েছে। চলুন জেনে নিই দারুচিনি আমাদের শরীরের কী কী উপকারিতা সাধন করে থাকে।

গাঁটের ব্যথায়

অনেকেই গাঁটের সমস্যায় ভুগছেন। এ ক্ষেত্রে দারুচিনিকে জয়েন্টের ব্যথা কমানোর ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। উষ্ণ গরম পানির মধ্যে এক চামচ মধু আর দারুচিনিগুঁড়া ভালোভাবে মিশিয়ে নিন, এরপর শরীরের ব্যথা স্থানে আস্তে আস্তে মালিশ করুন। ২-৩ দিন ভালোভাবে মালিশ করুন। কিছুদিন পর দেখবেন ব্যথা কমে যাবে।

পেটের সমস্যায়

দারুচিনি পেটের জন্য ভীষণ উপকারী। এটি অ্যাসিডিটির সমস্যা দূর করে ও পেটের ব্যথা উপশম করে। পেট পরিষ্কার করতে রাতে শোবার আগে দারুচিনির সঙ্গে হরীতকীর গুঁড়া মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। অ্যাসিডিটি রোধ করতে মধুর সঙ্গে দারুচিনি মিশিয়ে খেলে অ্যাসিডিটি ভালো হয়ে যায়।

রক্তে এলডিএল হ্রাসে

প্রতিদিন আধা চা–চামচ দারুচিনির গুঁড়া রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএলের মাত্রা কমায়। প্রতিদিন ২ ইঞ্চি পরিমাণ দারুচিনি দুই কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে সেই পানি এক কাপে নিয়ে এসে সেই পানি গরম–গরম চায়ের মতো করে দিনে তিন বার পান করলে কোলেস্টেরলের সমস্যা সমাধান হয়ে যায়, ডায়াবেটিস না থাকলে দারুচিনির পানিতে এক চা–চামচ মধু মিশিয়ে পান করতে পারেন।

টাইপ-২ ডায়াবেটিসে

রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। প্রতিদিন ২ ইঞ্চি পরিমাণ দারুচিনি দুই কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে সেই পানি এক কাপে নিয়ে এসে গরম–গরম চায়ের মতো করে দিনে তিনবার খেলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য অনেক উপকারী, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর।

শরীরের ছত্রাকজনিত সমস্যায়

অনেকে শরীরের নানান স্থানে ছত্রাকজনিত সমস্যা ভুগে থাকেন। তাঁদের জন্য দারুচিনি একটি আদর্শ সমাধান। ইস্ট ছত্রাকজনিত ইফেকশন প্রতিরোধ করতে প্রতিদিন ২ ইঞ্চি পরিমাণ দারুচিনি দুই কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে সেই পানি এক কাপে নিয়ে এসে গরম–গরম চায়ের মতো করে দিনে তিনবার পান করলে দারুচিনির গুণাবলি চমৎকারভাবে কাজ করে। ছত্রাকজনিত সমস্যা সমাধান হয়, বিশেষ ক্ষেত্রে ছত্রাকে উষ্ণ গরম পানির মধ্যে এক চামচ মধু আর দারুচিনিগুঁড়া ভালোভাবে মিশিয়ে নিন, এরপর শরীরের ছত্রাক স্থানে আস্তে আস্তে মালিশ করুন। ২-৩ দিন ভালোভাবে মালিশ করুন। কিছুদিন পর দেখবেন ছত্রাক কমে যাবে।

হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধে

হৃদ্‌রোগের অনেক ধরন রয়েছে, তার মধ্যে অনেকের বুকে চিনচিন ব্যথা, হাঁটতে কষ্ট হয়, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে কষ্ট হয়, তাঁদের জন্য দারুচিনি বেশ উপকারী। ১০০ গ্রাম জিরার গুঁড়া, ১০০ গ্রাম ধনিয়ার গুঁড়া, ৫০ গ্রাম দারুচিনির গুঁড়া একসঙ্গে মিশিয়ে এই মিশ্রণ এককাপ গরম পানিতে এক চা–চামচ মিশিয়ে চায়ের মতো পান করলে হৃদ্‌রোগীদের জন্য দারুণ উপকারী। এটি রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে, উচ্চরক্তচাপ ও কোলেস্টেরেলের সমস্যাও দূরে রাখে।

লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া প্রতিরোধে

মরণব্যাধি লিম্ফোসাইটিক লিউকোমিয়ার বিস্তার রোধ করে দারুচিনি। রক্ত জমাট না বাঁধার অসুখ হিমোফিলিয়া প্রতিরোধ করতে দারুচিনি বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন ২ ইঞ্চি পরিমাণ দারুচিনি দুই কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে সেই পানি এক কাপে নিয়ে এসে গরম–গরম চায়ের মতো করে দিনে তিনবার অথবা ১০০ গ্রাম জিরার গুঁড়া, ১০০ গ্রাম ধনিয়ার গুঁড়া, ৫০ গ্রাম দারুচিনির গুঁড়া একসঙ্গে মিশিয়ে এই মিশ্রণ এক কাপ গরম পানিতে এক চা–চামচ মিশিয়ে চায়ের মতো করে পান করলে লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়ার জন্য খুবই উপকারী। এটি রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে, যার ফলে লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়ার প্রকোপ কমে যায়, প্রোটিন–জাতীয় খাদ্য পরিহার করে প্রাকৃতিক খাদ্যবিধি মেনে চললে এই ব্যাধি ভালো হয়ে যায়।

বাতের ব্যথা ও শরীরের হাড়ের ব্যথায়

বাতের ব্যথা ও শরীরের হাড়ের ব্যথায় আধা চামচ দারুচিনির গুঁড়া এক চামচ মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে ব্যথা দূর হয়। তা ছাড়া দারুচিনি–মিশ্রিত শর্ষের তেল গায়ে মালিশ করলে ব্যথা ভালো হয়। এ ক্ষেত্রে পানি পানের বিষয়টি খুব ভালোভাবে খেয়াল করতে হয়, পানি কমও পান করা যাবে না, বেশিও পান করা যাবে না। তাই পরিমাণের ক্ষেত্রে সচেতন হয়ে পানি পান করতে হবে। কোনো অবস্থাতে পানিশূন্যতায় ভোগা যাবে না।

গলাব্যথা ও খুশখুশে কাশিতে

ঠান্ডায় গলাব্যথা বা খুশখুশে কাশিতে এককাপ গরম পানিতে দারুচিনি, মধু মিশিয়ে সারা দিনে ৬ বার চায়ের মতো করে খেলে গলায় আরাম পাওয়া যায় ও খুশখুশে কাশি কমে যায়।

স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাবে, এটা স্বাভাবিক নিয়ম। নিয়মিত প্রতিদিন একবেলা ২ ইঞ্চি পরিমাণ দারুচিনি দুই কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে সেই পানি এক কাপে নিয়ে এসে গরম–গরম চায়ের মতো করে পান করলে স্মৃতিশক্তি হ্রাস হওয়ার প্রবণতা কমে এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। এটা শিশুদের বেলায় প্রযোজ্য নয়।

সারা দিনে ২ চা–চামচের বেশি দারুচিনি খাওয়া যাবে না, দারুচিনি খাওয়ার কারণে ডায়রিয়া ও মাথা ধরার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যাঁদের এমন উপসর্গ দেখা দেবে, তাঁদের দারুচিনি না খাওয়াই উত্তম। বাজারে দারুচিনির নামে অনেক ধরনের গাছের ছাল দারুচিনি বলে বিক্রি হয়ে থাকে, কেনার আগে গন্ধ এবং একটু ভেঙে মুখে দিয়ে দেখুন ঝাঁজালো স্বাদ কি না। নিশ্চিত হলেই নেবেন। প্যাকেটজাত দারুচিনি পরিহার করুন।

লেখক: খাদ্য, পথ্য ও আকুপ্রেসার বিশেষজ্ঞ

প্রথম আলো থেকে সরাসরি পাঠ করতে এখানে ক্লিক করুন

Share

Recent Posts

পেট ভালো রাখতে মেনে চলুন আইবিএস ডায়েট

আপনি যদি ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, ফোলাভাব, গ্যাসসহ হজমের লক্ষণগুলো কাটিয়ে উঠতে চান, তবে আইবিএস ডায়েট অনুসরণ করার চিন্তা করতে পারেন। কারণ,… Read More

February 3, 2024

এই শীতেও কেন শসা খাবেন?

শসার রয়েছে নানা উপকারিতা। তবে সময় বুঝে খেলে তবেই কাজে লাগবে। না হলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণের কারণে… Read More

January 24, 2024

উপকারী ভেষজ চা বানাবেন যেভাবে

ভেষজ চা চিত্তাকর্ষক পুষ্টিমান, স্বাস্থ্য-উন্নয়নকারী অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসহ থেরাপিউটিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত উদ্ভিদ থেকে তৈরি করা হয়। শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং অসুস্থ হওয়ার… Read More

January 20, 2024

This website uses cookies.