পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা PCOS

মোটা হয়ে যাচ্ছেন? মহিলারা এই রোগে আক্রান্ত নন তো? দেখুন এর লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে

আধুনিকীকরণ এবং বিশ্বায়নের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে মানুষের জীবনযাপনের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। যার ফলে দিন দিন বেড়ে চলেছে রোগের প্রকোপ। হৃদরোগ, ক্যান্সার, ফুসফুসের সংক্রমণ, ডায়াবেটিস ইত্যাদির মতোই বর্তমান দিনে মহিলাদের কিছু বিশেষ শারীরিক রোগ দেখা দিচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতম পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা PCOS। চিকিৎসকেরা একে ওভারিয়ান সিস্ট হিসেবেও বলে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রথম দিকে বাড়ির মহিলা এবং পরিবারের লোকেরা এই সমস্যাকে গুরুত্ব দেন না। এর লক্ষণগুলি অর্থাৎ হঠাৎ করে মোটা হয়ে যাওয়া, মাথা থেকে চুল পড়া, মুখে ব্রণ এবং ঋতুস্রাবের সমস্যাকে বয়ঃসন্ধির ব্যাপার ভেবে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে পরবর্তীকালে এটি বড় আকার ধারণ করে।

২০১২ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বে মোট ১১৬ মিলিয়ন মহিলা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম দ্বারা আক্রান্ত। ভারতবর্ষের প্রায় ১০ শতাংশ মহিলা এই রোগে আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে প্রতি পাঁচ জন মহিলার মধ্যে একজন মহিলার এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কী এই পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম? চলুন জেনে নেওয়া যাক এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত।

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম কী?

বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক মহিলার ডিম্বাশয়ে এত বেশি ডিম্বাণু থাকে, যা বেরোতে সক্ষম হয়ে ওঠে না। সেই ডিম্বাণুর ঘরগুলোকে অনেকটা সিস্টের মতো দেখায়। একেই বলে পলিসিস্টিক ওভারি। আর ডিম্বাশয়ের এই অবস্থানের কারণে শারীরিক যেসব উপসর্গ দেখা দেয়, তা হল পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম। এই রোগের ফলে মেয়েদের শরীরে পুরুষ হরমোনের আধিক্য ঘটতে থাকে। যার ফলে শরীরের নানা অংশে অবাঞ্ছিত রোম গজিয়ে ওঠে। এটি মূলত প্রজনন সিস্টেমের ওপর প্রভাব ফেলে, যার ফলে গর্ভধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। বন্ধ্যাত্বের সাধারণ কারণগুলির মধ্যে এটি একটি কারণ হতে পারে। সাধারণত ১৩ থেকে ৩৫ বছরের মেয়েদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

PCOS হওয়ার কারণ কী?

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা PCOS কেন হয় তার সঠিক কারণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে কারণ হিসেবে তিনটে দিক উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ১) জিনগত কারণ। একজন মহিলার PCOS হওয়ার ঝুঁকি প্রায় 50 শতাংশ বৃদ্ধি পায় যদি তার পরিবারের কারুর থেকে থাকে। আবার কারুর ডায়াবেটিস থাকলেও পলিসিস্টিক ওভারি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ২) পরিবেশগত কারণ। ৩) জীবনযাত্রার কারণেও হতে পারে, যেমন – অনিয়মিত খাদ্যাভাস, ফাস্টফুডের প্রতি ঝোঁক, ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়া, উশৃঙ্খল জীবনযাপন করা এবং শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়ার মতো অভ্যাসের ফলে এই সমস্যা দেখা দেয়।

লক্ষণ
১) অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি ও মোটা হয়ে যাওয়া। এই উপসর্গ প্রথম প্রথম দেখা যায় না। পরের দিকে প্রকাশিত হয়।
২) ঋতুস্রাবের সমস্যা, যেমন – অনিয়মিত পিরিয়ড বা পিরিয়ড না হওয়া।
৩) ব্লাড ক্লট।
৪) মাথার সামনের অংশ থেকে চুল পড়ে যাওয়া।
৫) মুখে অযাচিত চুলের বৃদ্ধি।
৬) মুখে ব্রণ।

রোগ নির্ণয়
লক্ষণগুলির উপর নির্ভর করে আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। এছাড়া, রক্ত পরীক্ষা এবং টেস্টোস্টেরন, প্রোল্যাক্টিন, ট্রাইগ্লিসারাইডস, কোলেস্টেরল, থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন (টিএসএইচ) এবং ইনসুলিনের মাত্রা পরীক্ষার মাধ্যমেও নির্ণয় করা হয়।

চিকিৎসা
চিকিৎসকদের মতে, সঠিক সময়ে যদি এই সমস্যা ধরা পড়ে তবে ওষুধ সেবনের মাধ্যমে দ্রুত সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়। তবে ওষুধ প্রয়োগের আগে চিকিৎসকেরা রোগীর ওজন কমানোর বিষয়ে জোর দেন। পাশাপাশি সুষম খাবার গ্রহণ, ব্যায়াম ও ধূমপান ত্যাগের কথাও উল্লেখ করেন। যেহেতু ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের কারণে বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হয়, তাই যারা গর্ভধারণের চেষ্টা করছেন তাদের ক্ষেত্রে একটি ছোট্ট অস্ত্রোপচার করা হয় যার নাম ল্যাপারোস্কপি ওভারিয়ান ড্রিলিং।

ঝুঁকি
১) বন্ধ্যাত্ব
২) গর্ভাবস্থায় সুগারের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। টাইপ টু ডায়াবিটিস দেখা দেয়।
৩) লিভারের সমস্যা
৪) কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
৫) নিদ্রাহীনতা, উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতা।
৬) জরায়ু থেকে রক্তপাত
৭) অকাল জন্ম
৮) স্তন ক্যান্সার
৯) এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার

প্রতিরোধের উপায়
১) খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন করুন। জাঙ্ক ফুড ও ফাস্টফুড খাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিতে হবে। খাদ্যতালিকায় শাকসবজি, ফলমূল, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ খাবার খান। জল প্রচুর পরিমাণে পান করতে হবে।
২) নিয়মিত শরীরচর্চা মাস্ট।
৩) নিজের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৪) ধূমপান, মদ্যপান, চা ও কফি খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
৫) উশৃঙ্খল জীবনযাপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

অহেতুক ভয় না পেয়ে সঠিক সময়ে চিকিৎসা করান এবং প্রতিরোধ করার জন্য এসমস্ত নিয়মগুলি মেনে চলুন। অবহেলা করলে শুধুমাত্র বন্ধ্যাত্বই নয়, অন্যান্য শারীরিক জটিলতাও দেখা দিতে পারে। তাই নিজের প্রতি যত্ন নিন ও সুস্থ থাকুন।

 

Recent Posts

পেট ফাঁপার সমস্যা দূর করতে একটা এলাচিই হতে পারে মুশকিল আসান – আলমগীর আলম

এলাচি ছোট্ট একটি মসলা। অথচ সেটিতেই হতে পারে মুশকিল আসান। পেটে গ্যাস জমলে এই এলাচিতে মিলতে পারে সমাধান। খাওয়ার পরে… Read More

October 5, 2024

ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে পুদিনা পাতা | আলমগীর আলম

আপনি কি জানেন, পুদিনা মস্তিষ্কের সুরক্ষা দিতে এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে? সতেজ পুদিনাপাতার রস বা চা স্বাদের জন্য দুর্দান্ত।… Read More

October 5, 2024

এসি সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এড়ানো যাবে যেসব স্বাস্থ্যঝুঁকি – আলমগীর আলম

নগরজীবনে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ এক অনুপেক্ষণীয় বাস্তবতা। এর সঠিক ব্যবহার ও যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা গেলে এড়ানো যাবে অনেক ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকি।… Read More

August 13, 2024

This website uses cookies.